প্রকাশিত: Sun, Jun 2, 2024 3:24 PM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 1:40 AM

প্রকৃতি কি সত্যি নির্বোধ!

আহসান হাবিব

[১] মনে হয় না, আবার হয়ও। হয় কারণ প্রকৃতির নিজের অস্তিত্বের জন্য যা করা দরকার, সে তাই করে এবং এটা করতে গিয়ে তার বিবিধ উপাদানের যে বিপুল ক্ষতি হয়, তার দিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ থাকে না। আমরা, মানবপ্রজাতি যখন প্রকৃতির উপর আধিপত্য ফলাই, তখন প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন ঘটে। প্রকৃতি এই পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সাড়া দিতে গিয়ে যা করে, তা মানবপ্রজাতির সমূহ ক্ষতি হয়। তখন সে বলে ওঠে ‘প্রকৃতি নির্বোধ’! আসলে এটা তার নিজের অস্তিত্বের পক্ষে ডিফেন্স।

[২] আবার মনে হয় না, কারণ প্রকৃতি যদি নির্বোধ হতো তাহলে সে তার উপর যে নির্যাতন চলে, তা মুখ বুজে সহ্য করে যেতো। কিন্তু সে তা কদাচ করে না। বরং ক্ষতি হলেও সে রুখে দাঁড়ায় এবং নিজেকে তার মত সাজিয়ে নেয়। আসলে সে তার নিজের উপাদানগুলিকেই নবরূপে সাজায়। এটা করতে গিয়ে মানবপ্রজাতির দিকে তাকালে চলে না। শুধু মানবপ্রজাতি নয়, অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ সবই ক্ষতির মুখে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্য, সে তা আবার একজন মহান সেবিকার মত সারায় এবং সাজিয়ে তোলে। যদি নির্বোধ হতো, তাহলে প্রকৃতি এই যজ্ঞ কি করে করতো? আমার মনে হয় নির্বোধ ভাবার একটা বড় কারণ হলো আমরা তার ভাষা বুঝি না কিংবা বুঝতে চাই না। সুতরাং তাকে নির্বোধ বলাটা মানুষের একটি চরম স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ। [৩] প্রকৃতির দিক থেকে তাকালে দেখা যাবে এখানে কোন পাপ পূণ্য, ঠিক বেঠিক, পবিত্র অপবিত্র, হালাল হারাম,  বৈধ অবৈধ বলে কিছু নেই। শ্লীল অশ্লীল বলেও কিছু নেই। এইসব সমস্যা পৃথিবীতে কেবল একটিমাত্র প্রাণীর- মানুষের। মানুষ যখন প্রজাতি হিসেবে তার বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রকৃতি থেকে আলাদা হয়ে গেছে, তখন সে গড়ে তুলেছে নিজস্ব প্রকৃতি। এই প্রকৃতির নাম সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি। এইসব গড়তে গিয়ে প্রকৃতির সত্যকে সে পাল্টে ফেলেছে। এর ফলে দুটি কাজ হয়েছে: প্রকৃতির উপর আধিপত্য এবং সমাজে নিজ স্বার্থে মানুষকে বিভাজন করেছে। এর উদ্দেশ্য প্রধানত একটাই : অধীনস্থ রাখা, শোষণ করা। এই বিভাজন করতে গিয়ে তারা ঐ সমস্ত বিষয় আরোপ করেছে। অর্থাৎ এগুলি প্রাকৃতিক নয়, সামাজিক। আর যা সামাজিক, তাই রাজনৈতিক। আর যা রাজনৈতিক তাই স্বার্থপরতা।

নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মনগড়া বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। কে করেছে এসব? প্রধানত ধর্মের হাত দিয়েই এর যাত্রা শুরু। পরে রাষ্ট্র এটাকে গ্রহণ করেছে এবং এর সংগে আরো নানান বিষয় আরোপ করেছে। ফলে যার কোন দোষ নাই, তাকে দোষী করা হয়েছে, যার কোন পাপ পূণ্য বলে কিছু নাই, তাকে পাপাী বা পূণ্যবান বানানো হয়েছে। শ্লীল অশ্লীলের ধারণাটিও একই উদ্দেশ্যের ফল। এই যে আমরা নিজস্ব নির্মিত সমাজ বা রাষ্ট্রের উপাদান মানুষকে নিজের অধীনে রাখার জন্য নানারকম বিধিবিধান বা আইনকানুন বানালাম, তাতে কি হয়েছে? তাতে একে অপরের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে এবং এর ফলে যে পারস্পরিক সংঘর্ষের জন্ম হয়েছে তা বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের কারণ ঘটেছে।  [৪] আমার তাই মনে হয়, প্রকৃতির সত্য থেকে সরে বিকল্প প্রকৃতি এবং তার উপর আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে মানুষ যা করেছে তা উভয়ের ধ্বংসের কারণ হয়েছে। প্রকৃতিকে বিভক্ত করা, তাকে বদলে ফেলা এবং নিজের আরাম আয়েশ ও ভোগবিলাসের জন্য যা ইচ্ছা তাই করার ফলশ্রুতিই হচ্ছে প্রকৃতি এবং সমাজের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট হওয়া। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে এই যে বিশাল সামাজিক বিকাশ এবং সভ্যতার নির্মাণ, তার কি কোন মূল্য নাই? বিষয়টা মূল্য থাকা না থাকার সংগে সম্পৃক্ত নয়। বরং আমরা নিজেদের সভ্য দাবী করতে পারবো তখনই যখন প্রকৃতির টিকে থাকার মূল সত্যকে ধারণ করে নিজেদের কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করতে সক্ষম হবো। এযাবৎ যা কিছু ঘটেছে তা জবরদখল এবং সামাজিক নয়, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হীন অপকৌশল। এমন সমাজ কি নির্মাণ সম্ভব? সম্ভব। যখন আমরা প্রকৃতি এবং তার সমস্ত উপদানগুলির সহাবস্থানকে প্রকৃতির অভিপ্রায়ের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি মানব সমাজ নির্মাণ করতে সক্ষম হবো। আমার নিরীহ ভবিষৎবাণী হচ্ছে: মানুষকে তার নিজ স্বার্থেই এমন সমাজ নির্মাণ করতে হবে। লেখক: কথাসাহিত্যিক